ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

গরুর দুধেও বিষের ভয়

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদন :

নিজস্ব প্রতিবেদক ::
দেশে পুষ্টির অন্যতম প্রধান জোগান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে গরুর দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য। আর সেই দুধেই এবার মিলেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান। গতকাল রবিবার এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের প্রতিবেদনে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে।

গরুর খোলা দুধে অণুজীবের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭.৬৬ পর্যন্ত। আফলাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা ০.৫ হলেও পাওয়া গেছে ০.৯৯৬ পর্যন্ত। টেট্রাসাইক্লিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৬৭১.১৩ পর্যন্ত, সিপ্রোফ্লোক্সাসিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১৪৮.৩৬ পর্যন্ত। কীটনাশকের মাত্রা ৫ সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৯.৫০-১৬.২০ পর্যন্ত। প্যাকেটজাত দুধের ক্ষেত্রে টেট্রাসাইক্লিনের সহনীয় মাত্রা ১০০ হলেও দেশীয় প্যাকেটজাত দুধে পাওয়া গেছে ১৮৭.৫৮ পর্যন্ত। আমদানিকৃত প্যাকেটজাত দুধের ক্ষেত্রে এই উপাদানের মাত্রা ৭১৭.৮২ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আর আফলাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা ০.৫ হলেও পাওয়া গেছে ১.৯৩ পর্যন্ত।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গাভির খোলা দুধের ৯৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৯৬ শতাংশ দুধেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব। ১৫ শতাংশ দুধে মিলেছে মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা। ১৩ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি টেট্রাসাইক্লিন, ৯ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ও ৩ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আফলাটক্সিনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া বাজারে থাকা প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনার ৬৬-৮০ শতাংশে বিভিন্ন অণুজীব, ৩০ শতাংশে একইভাবে মানুষের শরীরের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার টেট্রাসাইক্লিন, একটিতে বেশি মাত্রার সিসা, কয়েকটিতে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ও এনরোফ্লোক্সাসিন পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে ৩৩টি দুগ্ধজাত দইয়ের নমুনায় ৬১ শতাংশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব, একটিতে সিসা পাওয়া গেছে।

একই গবেষণার আওতায় গাভির খাবারও পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে ৩০টি নমুনার মধ্যে ৬৯-১০০ শতাংশে কোনো না কোনো রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে। কোনো কোনোটিতে একই সঙ্গে কয়েক ধরনের রাসায়নিক পাওয়া গেছে। এর ভেতর দুটিতে কীটনাশক, ১৬টিতে ক্রোমিয়াম, ২২টিতে টেট্রাসাইক্লিন, ২৬টিতে এনরোফ্লোক্সাসিন, ৩০টির সব কটিতেই সিপ্রোসিন এবং চারটিতে আফলাটক্সিন পাওয়া গেছে।

গতকাল প্রতিবেদন প্রকাশকালে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের কারিগরি ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌস জানান, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের উদ্যোগে গরুর দুধ, গরুর খাবার, দুগ্ধজাত দই ও প্যাকেটজাত দুধের ওপর জরিপ চালানো হয়। গত বছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা জেলার ছয়টি উপজেলার ১৮টি এলাকা থেকে মোট ১৯০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে গরুর দুধ ও গো-খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে খামার থেকে, দই ঢাকার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান ও আশপাশের উপজেলার বাজার থেকে। আর বাজারে প্রচলিত সব ব্র্যান্ডের স্থানীয় ও আমদানিকৃত প্যাকেটজাত দুধের নমুনা সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন সুপার স্টোর থেকে। যা সংগ্রহ থেকে শুরু করে গবেষণাগারে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিয়ম মানা হয়েছে। এমন দুধ খাওয়া কতটা নিরাপদ এবং এই প্রতিবেদনের পর বাজারে থাকা দুধ খাওয়া উচিত হবে কি না—সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের মুখে অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌস এককথায় বলেন, ‘এগুলো খেয়েই তো আমরা বেঁচে আছি।’

অনুষ্ঠানের সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ওই প্রশ্নের আলোকে নিজের বক্তব্যের সময় বলেন, ‘যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে আমরা তো খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারব না। খেতে তো আমাদের হবে। তবে আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে একদিকে সতর্কতা আরেক দিকে এসব ক্ষতিকর উপাদান রোধে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া, দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।’

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমাদের এখন খাদ্য ঘাটতি নেই। পুষ্টির ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। এখন কেবল বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্যকে নিরাপদ করা ও রাখা। অবশ্যই খাদ্য মানসম্পন্ন হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে কোনো ছাড় হবে না। আর এই খাদ্যকে মানসম্পন্ন করতে এত দিন দেশে তেমন গবেষণাগার ছিল না। এখন সেই গবেষণাগার আছে, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা ফলাফল জানতে পারছি। আমাদের এই গবেষণাগারটি আইএসও ১৭০২৫ সনদ অর্জন করেছে, এটা খুবই বড় একটা ব্যাপার। এখন কেবল প্রয়োজন আমাদের সতর্ক থাকা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।’

তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপদ রাখার এ কার্যক্রম শুধুই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার নয়। আমরা কেবল পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের জন্য ক্ষতিকর উপাদান ধরিয়ে দিতে পারব আর রোগ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে পারব, সচেতন করতে পারব। কিন্তু এই কাজে কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সারা দেশের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের আরো সক্রিয় দেখতে চাই। তাদের আরো বেশি কাজে লাগিয়ে হাটে-বাজারে-দোকানে ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করা, ব্যবসায়ীদের সতর্ক করার কাজ জোরালো করতে হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান, এফএওর প্রতিনিধি ডেভিড ডুলান, নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ডুর্ক জি এদিমা, জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের পরামর্শক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. নিমুলেন্দু চৌধুরী বক্তব্য দেন।

পাঠকের মতামত: